শেলি রাইড: বিজ্ঞান জগতে মহিলাদের অন্তহীন অনুপ্রেরণা -

১৯৮৩ সালের ১৮ই জুন প্রথম উত্তর আমেরিকার মহিলা মহাকাশচারী হিসেবে শেলি কে. রাইডকে মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। ৩১ বছর বয়সী ক্যালিফোর্নিয়ার এই পদার্থবিজ্ঞানী স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার-এ করে মহাকাশে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। 

ছয় দিনের এই মিশনে শেলি তাঁর চার সহকর্মীর সঙ্গে মহাকাশে যাত্রা করেন এবং এটিকে তিনি এতটাই ভালবেসেছিলেন যে ঠিক পরের বছরই  তিনি আবার মহাকাশে যান।

লিঙ্গবৈষম্য-সহ অন্যান্য কারণে নাসাতে ঢুকেও তাঁর মহাকাশ যাত্রা অত্যন্ত কঠিন ছিল।  উত্তর দেওয়ার মতো কিছু থাকত না এরকম বহু প্রশ্নের সামনে তাঁকে পড়তে হয়েছিল তাঁর পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে। তাঁর যোগ্যতাও  প্রশ্নের মুখে পড়েছিল, কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমত্তা, অধ্যবসায় ও দৃঢ়তার জেরে অন্যদের সমালোচনা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ত।

বিজ্ঞান জগৎ ও মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে নাসার এই কৃতী সমকামী মহিলার (শেলি হলেন প্রথম সমকামী মহাকাশচারী যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে স্বীকৃত হয়), যিনি প্রায় একজন টেনিস তারকা হয়ে গেছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে জানতে নিচের গ্যালারিটি পড়ুন।

© Getty Images

ইতিহাস সৃষ্টি -

উত্তর আমেরিকার প্রথম মহিলা মহাকাশচারী হিসেবে তাঁর যতটা না খ্যাতি, তার থেকেও বেশি খ্যাতি তাঁর সম্পূর্ণ কর্মজীবন নিয়ে। 

© Public Domain

বিখ্যাত হওয়ার জন্যই জন্ম -

১৯৫১ সালের ২৬শে মে লস অ্যাঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়ার Encino এলাকায় ড্যালি বারডেল রাইড এবং ক্যারল জসি রাইডের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন শেলি ক্রিস্টান রাইড।

© Public Domain

বুদ্ধিমত্তা ও অন্য দক্ষতা -

পড়াশুনার লাইনে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ছাড়াও রাইড একজন দক্ষ অ্যাথলে্টিকও ছিলেন। কৈশোরে তিনি একজন জাতীয় পর্যায়ের টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন।

© Public Domain

উচ্চ প্রশংসা -

টেনিস তারকা বিলি জিন কিং শেলিকে স্ট্যানফোর্ড কলেজে পড়ার সময় পড়াশুনা ছেড়ে পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

© Getty Images

প্রশংসনীয় শিক্ষাগত কেরিয়ার -

তবে, পড়াশুনার ক্যারিয়ারের কাছে তাঁর টেনিস ক্যারিয়ার অনেকটাই ম্লান। তাঁর সমগ্র ক্যারিয়ারে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যাতে PhD সমেত চারটি বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

© Public Domain

মহাকাশচারী হিসেবে আবির্ভাব -

১৯৭৮ সালে নাসা স্পেস প্রোগ্রামে ৮০০০ আবেদনকারীর মধ্যে নির্বাচিত কয়েকজনের মধ্যে রাইড ছিলেন একজন।

© Getty Images

প্রযুক্তিগত দিকে প্রতিভা -

নাসার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্পেস শাটল ফ্লাইটে শেলি গ্রাউন্ড বেস ক্যাপসুল কম্যান্ডার হিসেবে কাজ করেন। স্যাটেলাইট পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যবহার করা রোবট তৈরিতেও তিনি অবদান রেখেছেন।

© Public Domain

প্রথম সফলতা -

১৯৮৩ সালের ১৮ই জুন, কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা নাসার সপ্তম স্পেস শাটল মিশনে অংশগ্রহণ করার জন্য আরও ৪ জন মহাকাশচারীর সাথে শেলিকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। 

© Public Domain

ইতিহাস সৃষ্টি -

নাসার এই মিশনটি রাইড এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সৃষ্টি করেছিল, কারণ তিনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম মহিলা মহাকাশ্চারী এবং বিশ্বে তৃতীয়। প্রথম ৮ জন নভশ্চরের দল থেকে তাঁদের নির্বাচিত করা হয়।

© Public Domain

এস.টি.এস. - ৭ অভিযাত্রীরা -

 এই যাত্রায় তাঁর সহকর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন রবার্ট এল. ক্রিপ্পেন (মাঝে), ফ্রেডেরিক এইচ. হক (নীচে ডানদিকে), জন এম. ফ্যাবিয়ান (উপরের বামদিকে) এবং নরমান এ. থাগারড (উপরের ডানদিকে)।

© Public Domain

অন্তরীক্ষ ভ্রমণে আগ্রহী -

নাসার এক সূত্র অনুসারে, ১৯৮৩ সালের ২৪শে জুন এই চ্যালেঞ্জার স্পেস ক্রাফটটি অবতরণ করার পর রাইড বলেছিলেন "এটি ছিল তাঁর জীবনের এক মজাদার অভিজ্ঞতা।"

© Public Domain

লিঙ্গবৈষম্য -

মহাকাশ মিশনে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও টেক অফের আগে রাইডকে অপমানজনক অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যেমন একজন সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে কীভাবে এই উড়ান তাঁর প্রজনন অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে। 

© Public Domain

বিজ্ঞান জগতে নারী বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল -

১৯৮৩ সালের এস টি এস ৭ নাসা মিশন শেষ হওয়ার পর একজন সাংবাদিক একটি প্রেস কনফারেন্স চলাকালীন রাইডকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি হতাশ হয়ে কাঁদেন কিনা।  

© Public Domain

সাবলীলভাবে রেকর্ড সৃষ্টি করেন -

রাইড অত্যন্ত সাবলীলভাবে এই যৌনতাবাদী প্রশ্নের সহজ উত্তর দিয়ে বলেছেন "কেন তারা (এস টি এস ৭-এর পাইলট) রিক (হক)-কে এইসব প্রশ্ন করেন না।"

© Getty Images

নতুন অধ্যায় -

১৯৮৯ সালে রাইড নাসা ত্যাগ করেন এবং সান দিয়েগোতে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া স্পেশ ইন্সিটিউট-এ তাঁর নতুন কর্মজীবন শুরু করেন।

© Getty Images

শিক্ষাবিদ -

রাইড একজন পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন এবং একইসঙ্গে কিছুদিনের জন্য তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের জন্যও কাজ করেছেন।

© Getty Images

শিক্ষার প্রসার -

১৯৯০-এর দশক থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাইড তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় নাসার হয়ে দুটি মিডল স্কুলে (ISS EarthKAM and GRAIL MoonKAM প্রোজেক্ট) শিক্ষামূলক প্রচার কর্মসূচীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিখ্যাত এই মহাকাশচারী হৃদয় দিয়ে এই কাজ করতেন।

© Getty Images

প্রতিষ্ঠানের মালিক -

নাসা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ২০০১ সালে শেলি রাইড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যার উদ্দেশ্য ছিল যুবতী মেয়েদের বিজ্ঞান ও গণিতে ক্যারিয়ার গড়তে উৎসাহিত করা।

© Getty Images

শিশুদের জন্য -

নাসা থেকে অবসর নেওয়ার পর শেলি রাইডের উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের মহাকাশ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা এবং সেক্ষেত্রে তাঁর উজ্জ্বল অবদান রয়েছে। তিনি শিশুদের জন্য অনেক ধরনের মহাকাশ বিষয়ক বইও লেখেন।

© Getty Images

ঐতিহ্য সৃষ্টিকারিণী -

নাসা-তে কর্মজীবন এবং তার পরবর্তীকালেও রাইড সেইসব মেয়ে ও মহিলাদের জীবনে অনুপ্রেরণা প্রদান করেছিলেন যারা এই পুরুষ শাসিত সমাজে নিজেদের পরিচয় গড়ে তুলতে চায়। 

© Getty Images

একজন গবেষক ও তদন্তকারী হিসেবে -

২০০৩ সালে ১১৩তম স্পেস শাটল ফ্লাইটের এস টি এস ৭ কুশলীদের মৃত্যুর পর তিনি কলোম্বিয়া দুর্ঘটনা তদন্ত বোর্ডে কাজ করেছিলেন। 

© Public Domain

এক মর্মান্তিক ক্ষতি -

২০১২ সালের ২৩শে জুলাই, শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক রাইড যখন অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন সমগ্র বিশ্ব শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল।

© Getty Images

অমরত্ব -

সাহসিকতা ও প্রতিভার মূর্ত প্রতীক হিসাবে বিবেচিত এই শেলি-র মৃত্যুকালে বিজ্ঞানী, সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে এমনকী বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও তাঁকে সন্মান জানানোর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। 

© Public Domain

সন্মানীয় তুলনা -

২০১৩ সালে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শেলির জীবনসঙ্গী, বিজনেস পার্টনার এবং রোমান্টিক পার্টনার Tam O'Shaughnessy-কে শেলির হয়ে মেডেল অব অনার প্রদান করেন।

© Getty Images

সন্মানীয় উক্তি -

হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতি জারি করে ওবামা বলেন যে বিদ্যালয়ে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষাতে তাঁর জীবনব্যাপী অবদান অনস্বীকার্য। যুবতী মহিলাদের বহু প্রজন্ম তাঁর মহাকাশ যাত্রাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে লাগাবে - সি.এন.এন.-এর থেকে প্রাপ্ত খবর অনুসারে।

© Getty Images

বিজ্ঞানীদের উক্তি -

সংবাদসংস্থা সি এন এন-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে শেলি মারা যাওয়ার পরে চাঁদে প্রথম পদার্পণকারী বাজ আল্ড্রিন ট্যুইট করেন যে "বন্ধু ও সহকর্মী মহাকাশচারীকে হারিয়ে তিনি মর্মাহত। মহিলাদের মধ্যে এবং মহাকাশযাত্রাতে তিনি সর্বদাই এক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবেন।"

© Public Domain

হলিউডের স্বীকৃতি -

বিখ্যাত অভিনেতা এবং ১৯৯৫ সালের 'অ্যাপোলো-১৩' সিনেমার তারকা টম হাঙ্কস ট্যুইট করে বলেন যে "ভালো থেকো শেলী রাইড, তার মতো আমরাও লক্ষ্যে অবিচল থাকার চেষ্টা করি" - ই নিউজের সূত্র মারফত।

© Getty Images

বিজ্ঞজনের উক্তি -

ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, নাসা প্রশাসক চার্লস বল্ডেন শেলির প্রশংসা করে বলেন যে, "শেলি রাইড তাঁর পেশাদারিত্বের মাধ্যমে সমস্ত বাধা অতিক্রম করেছেন এবং আমেরিকার মহাকাশ অভিযানের মানে আক্ষরিক অর্থে বদলে দিয়েছেন।"

© Public Domain

অন্তহীন এক সম্পত্তি -

বল্ডেন আরও বলেন যে, "দেশ একজন অন্যতম নেত্রী, শিক্ষিকা তথা অনুসন্ধানকারীকে হারাল। দেশ তাঁর অভাব উপলব্ধি করবে কিন্তু তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সর্বদা জ্বলজ্বল করবেন"।

© Public Domain